Sunday, August 14, 2016

PICE HOTELS OF KOLKATA - JOGONMATA BHOJONALOY (জগন্মাতা ভোজনালয়)


নিখাদ বাঙালি খাবার যদি তৃপ্তি করে, মানে সোজা ভাষায় যদি কব্জি ডুবিয়ে খেতে চান আবার পকেটের ওপর বিশেষ চাপ সৃষ্টি না করেই, তাহলে কিন্তু কোলকাতার পাইস হোটেলের কোন জবাব নেই। কলকাতার ঐতিহ্য আর খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে পাইস হোটেল বহুদিনে ধরে জড়িয়ে আছেআমার কাছে পাইস হোটেল মানেই পুরোণ কলকাতার গন্ধ মাখা নস্টালজিয়া, ব্ল্যাকবোর্ডে চকে লেখা মেনু, মলিন নোনা ধরা দেওয়াল, মাথার ওপর উঁচু  কড়িকাঠ লাগানো সিলিঙতে ঝোলানো অলসগতির ফ্যান, বেশ কিছুটা হৈ হট্টগোল, খাবার দেন যারা তাঁদের নামতা পড়ার মত একটানা সুরে সেদিনের মেনুর বিবরন, কাঠের টেবিলে অচেনা মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা, টেবিলের ওপর বাটিতে নুন লঙ্কা, কলাপাতায় গরম ভাত, পাতিলেবু, নিরামিষ তথা মাছমাংসর জিভে জল আসা হরেক পদ আর বেরোনর সময় খামচা মেরে ক্যাশ কাউন্টারে বাটিতে রাখা মৌরী। এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।

ইদানিং কলকাতাতে নামিদামি, মহার্ঘ্য, শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাঙালি খাওয়ার রেস্টুরেন্ট বহু খুলেছে বটে কিন্তু তাদের দাপট সামলেও কলকাতায় এখনো বেঁচে আছে পাইস হোটেলের নিজস্ব ঘরোয়া ঐতিহ্য।

ঠিক কখন থেকে যে এই পাইস হোটেলের শুরু বা ‘পাইস হোটেল’ নামটাই বা কিভাবে এল নিশ্চিত করে বলা খুব মুশকিল, এর কোন প্রামান্য ইতিহাসও আমি খুঁজে পাই নি। তবে পুরনো কলকাতার ইতিহাস আমি যেটুকু পড়েছি তাতে আমার নিজস্ব ধারণা পাইস হোটেলের শুরু এখন থেকে প্রায় দেড়শ বছর বা তারও আগে থেকে যখন কলকাতা ইংরেজদের হাতে গড়ে উঠছে ভারতবর্ষের রাজধানী শহর হিসেবে। বহু সরকারী প্রশাসনিক দপ্তর ছাড়াও হু হু করে তৈরী হচ্ছে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেগুলির পুরোভাগে ইংরেজ্ বনিকরা ছাড়াও ছিলেন  অনেক উদ্যোগপতি বাঙ্গালী পরিবারও। দেশে ইংরেজি শিক্ষার চলও বাড়ে এই সময় থেকেই। অতএব দেশগঞ্জ থেকে বহু বাঙ্গালীর স্রোত আসা শুরু হয় কলকাতার দিকে, মূলত জীবিকা, পেশা এবং শিক্ষালাভের খোঁজে। কলকাতায় এসে পড়লেও এঁদের বেশিরভাগেরই আর্থিক সংস্থান ছিল খুবি সীমিত, করণিক বা বাবুর চাকরীতে বিশেষ অর্থ সমাগম হত না, নিজের খরচখরচা মিটিয়ে হাতে বাঁচত অতি সামান্যই, ছাত্রদের অবস্থাতো আরও খারাপ। ফলে এঁদের পরিবার পরিজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থেকে যেত দেশগাঁয়ের বাড়িতেই। কিন্তু একলা হলেও মাথা গোঁজার জায়গা তো চাই আবার বাড়ি ভাড়াও একার সাধ্যে কুলোবে না। অতএব এখান থেকেই জন্ম হয় মেস কালচারের। এক বাড়ীতে ছোট ছোট ঘরে চৌকি পেতে অফিসবাবু আর পড়ুয়াদের সহাবস্থান, চাঁদা করে বামুন রেখে রান্নার বন্দোবস্ত। বাজারের ভার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একেকদিন একেকজনের ওপর।এই হলো বাঙ্গালীর মেসবাড়ি। এই মেস কালচার কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে গেলে বঙ্গজীবনের অঙ্গ ছিল এবং এখনো কিছুটা বেঁচে আছে।বাকিটা ভোল বদলে হয়েছে পেয়িং গেস্ট।

ফিরে দেখলে দেখি বাংলা সাহিত্য এবং সিনেমায় মেসবাড়ির রমরমা উপস্থিতি। বহু প্রখ্যাত সাহিত্যক মায় তাঁদের সৃষ্ট চরিত্ররা পর্জন্ত মেসবাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। শিব্রাম চক্রবর্তী তো আজীবন মেসেই কাটিয়ে গেলেনআবার মেসবাসী ঘনাদা বা প্রথম যৌবনের ব্যোমকেশকে কি ভোলা যায়? মেস বাড়ির রঙ্গ নিয়ে তৈরী হয়েছে বহু দমফাটা হাসির গল্প আর বাংলা সিনেমাও। যাই হোক প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে মেসবাড়ি নিয়ে কচকচির কারণ একটাই, পাইস হোটেলের উত্থানের পিছনে এই মেসবাসী বাঙ্গালিদের একটা বিশেষ অবদান আছে। মেসের দৈনন্দিন জোলো আলুনিমার্কা খাবার খেয়ে গ্রাম বা মফঃস্বল থেকে আসা মানুষগুলো বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়তেন। সুদুর গ্রামে মা, ঠাকুমা বা স্ত্রীর হাতের রান্নার জন্য এঁদের প্রান ব্যাকুল হয়ে উঠত। ঠিক এখান থেকেই অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ব্যাবস্থা হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে পাইস হোটেলগুলি। স্বল্প পয়সায় সুস্বাদু এবং নিখাদ বাঙ্গালী রান্নার স্বাদ বাড়ির খাওয়া না পাওয়ার দুঃখ কিছুটা হলেও হয়ত উপশম করত।

পাইস কথাটার উতপত্তি নিয়েও বিতর্ক আছে। শোনা যায় সস্তা বা কম পয়সার হোটেল থেকে অপভ্রংশে ‘পাইস’ কথাটা আসে।যদিও এর কোন ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য আমি হাজির করতে পারব না। এটা শুধুই অনুমান।ইংরেজ আমলে পয়সা ছিল পাইস, এই মেট্রিক যুগের হিসেবের সঙ্গে মিল নেই। পয়সার পর আনার হিসেব, তাতে দাঁড়ালো চার পয়সায় এক আনা, আর ষোল আনায় এক টাকা। কিন্তু সেই যুগে পয়সার দাম ছিল, এক পয়সায় জুটত ভাত ডাল তরকারির পেটচুক্তি খাওয়া। সেই থেকেই হয়ত লোক মুখে পাইস হোটেল কথাটা চালু

এই ভাবেই পথ চলা শুরু কলকাতার অধিকাংশ পুরনো পাইস হোটেলগুলির। শতবর্ষ পেরিয়ে এখনো  কলকাতার বুকে কিছু পাইস হোটেল তাদের ঐতিহ্য ধরে টিঁকে আছে, কিছু হারিয়ে গেছে কালের নিয়মে। এগুলির বেশির ভাগেরই খোঁজ পাওয়া যাবে উত্তর বা মধ্য কলকাতায়। প্রাচীনত্বে দক্ষিণ কলকাতা বহু পিছিয়ে সেজন্য দক্ষিণে এদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় এবং যা আছে সবগুলিই বয়েসে অপেক্ষাকৃত নবীন। 

আমি নিজে একজন পাইস হোটেলের ভক্ত। কাজেকর্মে টো টো করে ঘোরার সুবাদে অনেক পাইস হোটেলেই খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সবকটিই যে ভালো তা বলব না।মুষ্টিমেয় কিছু হোটেল এখনো নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখে গুণমানের সঙ্গে কোন আপস করে নি আবার কিছু হোটেলের খাবার মোটামুটি চলনসই থেকে একেবারে বাজে, সবই আছে। তবে আমি দেখেছি যে কটি শতবর্ষ পার করা প্রতিষ্ঠান আছে সবগুলিই অনবদ্য

এমনিই এক হোটেল জগন্মাতা ভোজনালয়। এখানে আগে যাওয়ার সুযোগ আমার হয় নি। যদিও ইচ্ছেটা মনের মধ্যে ছিলই। সেদিন দুপুরে একটা কাজে যেতে হয়েছিল গিরিশ পার্ক, কাজ শেষ হলো তাড়াতাড়িই, অতএব হাতে রইলো বেশ কিছুটা সময় আর সময়টাও দুপুর একটা।এখান থেকে কৈলাস বোসে স্ট্রীট প্রায় হাঁটা পথ। বিবেকানন্দ রোড ধরে এসে, বিধান সরনীর মোড় থেকে শ্রীমানি মার্কেটের দিকে একটু এগোলেই বাঁহাতি রাস্তা। বর্ষার দুপুর, একটু আগেই ঝেঁপে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, একটা গাড়ীবারান্দার নিছে দার্ড়িয়ে মাথা বাঁচালাম।বৃষ্টি একটু ধরতেই হাঁটা শুরু। হাওয়ায় ভেজা গন্ধ, বৃষ্টিভেজা কংক্রিটের রাস্তা ভাপ ছাড়ছে, পুরনো বাড়ীগুলোর ফাঁকে ফাঁকে অযত্নে বেড়ে ওঠা মলিন গাছগুলও এখন সতেজইতস্তত জমা জল, ভিজে ট্রাম্ লাইন চকচক করছে।চারদিকে আলিস্যি ভাব, শহরটা যেন আড়মোড়া ভাঙ্গছে।বাসরাস্তা ছেড়ে কৈলাস বোস স্ট্রীট ধরে কয়েক পা হাঁটতেই সাইনবোর্ডটা নজরে এল। একটি জীর্ণ, সরু লম্বাটে গড়নের দোতলা বাড়ীর গায়ে লাগানো।বাহারি নয়, টিনের ওপর হাতে রঙ করা, আর একটি ফ্লেক্স। লেখা জগন্মাতা ভোজনালয়, বাংলা, ইংরেজীর সঙ্গে ওডিয়া ভাষাতেওবোঝা গেলো প্রতিষ্ঠাতা আদতে উৎকল নিবাসী।


বাড়ির গায়েই বাঁদিকের সরু গলি দিয়ে গিয়ে ভিতরে ঢোকার দরজা, বাড়িটির গড়ন অনেকটা যেন রেল গাড়ির কামরার মতো, পরপর তিনটি ঘর ঢুকেই যেটি প্রথম ঘর সেখানে সামনেই ছোট্ট কাঠের ক্যাশ কাঊন্টার, পিছনের দেওয়ালে বাংলা ক্যালেন্ডারে মালক্ষীর বড় ছবি। তার দুপাশে ফ্রেমবন্দী দুই বৃদ্ধর বহু পুরনো সাদাকালো ছবি, শুকনো গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। পাশেই চোখ টেনে নেবে একটা বড় খুনখারাপি লাল রঙের মেনূ বোর্ড, সাদা খোপে ফেল্ট পেন দিয়ে লেখা দাম। ব্ল্যাকবোর্ডেরই একটু আধুনিক রূপ আর কি। তাতে রকমারী মাছের পদেরই আধিক্য। রুই, কাতলা থেকে শুরু করে ইলিশ, বাটা, ট্যাংরা, চিংড়ী, পার্শে, কই, মাগুর, পমফ্রেট, পাবদা, চিতল, শোল, মায় কাঁকড়াও আছে।  


এই ঘরেই কাঠের টেবিল চেয়ার পেতে খাওয়ার বন্দোবস্ত। মলিন নোনা ধরা দেওয়ালে অচিন সব দেশের ম্যাপ। উঁচু কড়িবরগার সিলিং থেকে ঝুলছে মন্থরগতির ফ্যান। 


তার পিছনের ঘরটি অবশ্য ফাঁকা, টেবিল চেয়ারের  বালাই নেই, সেখানে একদম মাটিতে চাটাই পেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে খেতে পারেন। কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রথম ঘরটিতে একই ব্যাবস্থা ছিল কিন্তু কালের নিয়মে পালটেছে বা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন এনারা। 


শেষ ঘরটি, হেঁশেল, যথারীতি আধো অন্ধকার, মসীবর্ণ দেওয়াল,কয়লার উনুন আর প্রমাণ সাইজের হাঁড়ীকড়ার সমাহার।  



হেঁশেলে এবং পরিবেশনায় যারা আছেন, অধিকাংশই উৎকলবাসী,সবাই ট্রেডমার্ক লাল চেক গামছা এবং গেঞ্জি শোভিত। এতে উৎসাহিত হবার কারণ আছে অবশ্যইবহু কাল ধরেই বাঙ্গালীর বারো মাসে তেরো পার্বন, অন্নপ্রাশন, পৈতে, বিবাহ মায় শ্রাদ্ধতে যে বিপুল খাওয়াদাওয়ার আয়োজন তার নেপথ্য শিল্পীরা কিন্তু এই উৎকলবাসীরাই। এঁদের রক্তে আছে রান্না। অনেক যুগ পেরিয়েও আজকালকার বহু নামিদামী ক্যাটারারদেরও প্রানভোমরা হলেন এই মানুষগুলোই।

বর্ষার দুপুরে ভিড় বিশেষ নেই, বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হল না। মাটিতে বসার দিকে যাইনি, শহুরে হাঁটু বিদ্রোহ করবে।টেবিল চেয়ারই ভালো। বসার সঙ্গে সঙ্গেই চলে এলো কাঁসার থালার উপর কলাপাতায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, তার উপর বাটিতে বসানো ডাল আর ডাঁটার সব্জি, আমের চাটনি, পেঁয়াজ আর পাতিলেবুমাটির ভাঁড়ে জল। এটা শুরু, তারপর আমিষ মেনু আপনার মর্জিমতো। বর্ষার দুপুরে মাছের পদ দিব্বি জমবে, সুতরাং ঢেলে অর্ডার দেওয়া হলো চার রকমের মাছের পদ, ট্যাংরা আর চিংড়ী মাছের ঝাল,তার সাথে পার্শে আর কাতলা মাছের পেটি ভাজা। সব মাছেরই দারুন সাইজ, বড়ো সাইজের দিম ভরা ট্যাংরা মাছ, পেঁয়াজ দেওয়া পাতলা ঝোল সহ, দুটো বেশ বড় সাইজের চিংড়ির ঝাল। পাঠককে বরং বলি এই সময় লেখাটা ছেড়ে ছবিগুলোতে নজর দিন, বেশ একটা আন্দাজ পাবেন। মাছ ভাজাও দারুন, স্বাদেই বোঝা যায় মাল একদম ফ্রেশ। সব রান্নাই খুব সুস্বাদু। সবচেয়ে বড় কথা তেল মশলার কোন আধিক্য নেই কিন্ত স্বাদে কোনও খামতি নেই। পাইস হোটেলের মুল লক্ষ্যই ছিল মানুষকে বাড়ির রান্নার স্বাদ দেওয়া এবং রোজকার খদ্দেরও যাতে অম্ল বা পিত্তশুলে না ভোগেন সেটা নিশ্চিত করা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে জগন্মাতা ভোজনালয় ১০০ তে ১০০, সেই ট্রাডিশান সযত্নে পালন করা হচ্ছে





খুব যত্ন করে খাওলালেন এঁরা। আমার মতো যারা আশির দশক বাঁ তারও আগে বাঙ্গালীর বিয়ে বাড়ীতে খেয়েছেন, তাঁরা হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। তখন বাড়িতেই ঠাকুর এনে রান্না হত, ভিয়েনও বসত। পরিবেশনের কোন কোট এবং হাতে গ্লাভস পরা কেটারিং এর লোক থাকত না, পাড়ার উৎসাহী ছেলেরাই সে দ্বায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে নিত। তাতে পেশাদ্বারিত্তের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও আন্তরিকতার অভাব কোনদিনও ছিল না।  

উপরিউক্ত পদগুলির জন্য মুল্য পড়ল, সাকুল্যে ৪৪০ টাকা। এটাকে মুল্য বলার চেয়ে সন্মান দক্ষিণা বলা বরং মনে হয় বেশি উপযুক্ত।

কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক গম্ভীর প্রকৃতির এবং কিছুটা মিতভাষী। আমাদের অকুন্ঠ প্রশংসা শুনে অবশেষে গোঁফের ফাঁকে হাল্কা হাসির রেখা ফুটল। নাম গঙ্গাধর মিশ্র। ওনার থেকেই জানা গেল প্রতিষ্ঠানটির বয়স একশ পেরিয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠা্র সালটি তিনি ঠিক বলতে পারলেন না। ঊডিষ্যা থেকে এক সুদুর অতীতে এক যুবক ভাগ্যান্বেষণে এসে পড়েছিলেন এই কোলকাতা শহরে, নাম বিকলচন্দ্র দাস। সম্বল ছিল শুদু হাতের অসাধারণ রান্না। সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়েই পথ চলা শুরু জগন্মাতা ভোজনালয়ের। এঁরই ফোটো ঝুলছে কাউন্টেরের পিছনে। এখন মালিকানা তৃতীয় প্রজন্মের হাতেরান্নার ভার এখন ওডিয়া রাঁধুনিদের হাতেই, তাঁরাই এখনও ম্যাজিক দেখিয়ে চলেছেন। গুনমানের সঙ্গে কোন আপস নেই, সেই পুরোন রীতি অক্ষুন্ন রেখেই খদ্দের আপ্পায়নের বন্দোবস্ত।


বিগত দিনের হেঁশেলের নিয়ম মেনে এখানে আজও মুরগীর মাংস আর ডিমের প্রবেশ নিষেধ। শুধু পাঁঠার মাংস হয় কিন্তু বৃহস্পতিবার ছাড়া। সুতরাং মাংসবিলাসীরা ক্যালেন্ডার দেখে যাবেন। মাছের পদের রমরমা সবদিনই। আর রুটি কিন্তু পাওয়া যায় না, শুধুই ভাতের বন্দোবস্ত।

খোলার সময় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টে। আবার সন্ধ্যা ৮টা থেকে রাত ১১টা অবধি চলে অতিথি আপ্যায়নের পালা।          

ঠিকানাঃ
জগন্মাতা ভোজনালয়
৪০,কৈলাস বোস স্ট্রীট,
কলকাতা – ৭০০ ০০৬,

আমার কাহিনীটা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু একটু উপসংহার আছে সেটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।


কৈলাস বোস স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে বিধান সরনীতে উঠলেই, রাস্তার উল্টোদিকে কপিলা আশ্রম, আরেকটি শতবর্ষের পুরোন শরবতের দোকান। দোলের দিন এদের বিখ্যাত ভাং শরবতের বিপুল চাহিদা। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন অলস দুপুরে দোকান খদ্দেরবিহীন, ভিতরে আলো আঁধারীতে একজন মানুষ ঝিমোচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতে জানা গেলো শুধু কেশর মালাই শরবৎ পাওয়া যাবে। তাইই সই, নইলে ব্যাপারটার একটা মধুরেণ সমাপয়েত হচ্ছিল না। 



ত্রিশ টাকা গ্লাস। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কাঁচা সোনা রঙের সেই অমৃত তৈরী হলো। ফেনা ওঠা, মালাই মারা। খেয়ে মন খুশি করে আবার হাঁটা। 

ঠিকানাঃ
কপিলা আশ্রম
২০৪/২, বিধান সরনী,
কোলকাতা – ৭০০ ০০৬
শ্রীমানি মার্কেটের পাশে।


এবার একটু এগিয়েই বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং এ বিখ্যাত পানের দোকান।

খাইকে পান বনারসওলা...


PICE HOTELS OF KOLKATA - HOTEL SIDDHESWARI ASHRAM (হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম)



কালীপুজোর পরদিন অফিস যাওয়াটাই অভিশাপ পুরো কলকাতা ঝিম মেরে আছে শহরটা কাল রাতের ঘোর এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি অতিকষ্টে কোঁত পাড়তে পাড়তে অফিসে পৌঁছে  বিরস বদনে টেবিলে বসে আছি, চোখে ঘুম জড়াচ্ছে, সামনে ল্যাপটপ এর স্ক্রীন ঝাপসা, কাজে মন নেই, দেহ বলছে 'ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু'

দুপুর গড়ালে পেটে ক্ষিদের আগুন, আর প্রস্তাবটা সেই সময় এলো সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমে গেলে হয় না? মুহুর্তেই ক্লান্তি ঝেড়ে আমি রেডি চার বাঙ্গালী ট্যাক্সি ধরে দে গোল্লাছুট কাজ থাকুক আমি আসি...


পাইস হোটেল রসিকদের জন্য সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম তীর্থস্থানই বটে নামটা সার্থক সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই সেই পীঠস্থান ডানদিকে ঘরের ভিতর ঘর, উপরে কড়িকাঠের সিলিঙে ঢিমেতালে ঘুরছে আদ্দিকালের ফ্যান কাঠের বেঞ্চি আর মার্বেল টপের কাঠের টেবিল পাইস হোটেলের ঐতিহ্য মেনে ঢোকার মুখেই ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে পদ এবং মূল্য তালিকা বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই মাথায় তারিখটি অবশ্য বাংলা মাসের হিসাবে লেখা এছাড়া বোর্ডের মাথায় গনেশ বন্দনা।

একটু আগে পৌছবার দরুন বসার জায়গা মিলল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এখানে একটু দুপুর গড়ালেই ভিড় বাড়ে, জায়গা পাওয়া দুস্কর হয়..এবং পেটে খিদে নিয়ে শুরু হয় প্রতীক্ষার প্রহর গোনা


গুছিয়ে টেবিল দখন করে বসতেই কলাপাতা বসানো স্টিলের থালাতে ভাত এবং মাটির ভাঁড়ে জল হাজির তারপরে শুধুই এক স্বপ্নিল সময়ের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাওয়া ঝপ ঝপ হাজির ধোঁয়া ওঠা সরু চালের ভাত, নারকেল দেওয়া ঘন এক বাটি ডাল, ঝুরি আলু ভাজা, আলু পটল পোস্তর তরকারী হলো গিয়ে স্ট্যান্ডার্ড স্টার্টার এর পরে জমিয়ে অর্ডার করা হলো, পাবদা মাছের সর্ষে বাটা, পার্শে মাছের ঝাল, আর বড় গলদা চিংড়ির মালাইকারি সবকিছুই আকারে অতি বৃহৎ এবং অতি সুস্বাদু পাবদা মাছের মাথা এবং ল্যাজ দুটি কোয়ার্টার প্লেটের গন্ডি ছাড়িয়ে আরো বহুদূর বিস্তৃত পার্শে এবং চিংড়ির সাইজও শ্রদ্ধার উদ্রেক করে মৎস্য বাবাজিরা সসন্মানে উদরস্থ হবার পরেই খোজ করা হলো পাঁঠার দু কোয়ার্টার পাঁঠার মাংস বলামাত্রই হাজির অতীব সুপক্ক সুসিদ্ধ সে মাংস স্বাদে গন্ধে অনির্বচনীয় ঝোলটি লেবু চিপে ভাতে মেখে খেলেই মনে হয় "স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানে.. তা এখানে.......


রসিকজনেরা যদি যেতে চান কোনো এক মধ্যাহ্নে, পৌছে যান জানবাজার, ১৯ নং রানী রাসমণি রোড, কলকাতা ৭০০ ০৮৭ প্রতিষ্ঠানটি ১৯২৫ সন থেকে সুস্বাদু এবং সর্বপরি হালকা এবং সহজপাচ্য খাওয়া পরিবেশন করে আসছে
যদি পাইস হোটেল ঘরানা ধাতে সয়, খেয়ে প্রভূত আনন্দ পাবেন গুছিয়ে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুরটা তুললেই বুঝবেন........

বসন্ত এসে গেছে .......................

ঠিকানাঃ 
হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম
১৯, রানী রাসমনী রোড

জানবাজার, কোলকাতা - ৭০০ ০৮৭

PICE HOTELS OF KOLKATA - JAGANNATH BHOJONALOY (জগন্নাথ ভোজনালয়)


আজ ছিলো 'জগার' দিন.....

জগাটা আবার কে? আহা জগা হলো গিয়ে আদরের ডাক নাম.... জগার গুনমুগ্ধরা তাঁকে আদর করে এই নামেই ডেকে থাকেন ....

একটা ভালো নাম তো আছেই,... জগন্নাথ,....পুরো বললে 'জগন্নাথ ভোজনালয়'..... হ্যা ঠিক ধরেছেন,....এই জগন্নাথকে পাবার জন্য পুরীধাম দৌড়োনোর প্রয়োজন নেই, এটি ঘরের কাছেই, কলকাতার একটি বিশিষ্ট পাইস হোটেল। বিগত প্রায় ষাট বছরের ওপর ভোজনবিলাসী জনগণেশের সেবায় নিয়োজিত।

এনার অধিষ্ঠান এস এন ব্যানার্জী রোডে, টাইমস অফ ইন্ডিয়া অফিসের ঠিক পাশে।


তা আজ গিয়েছিলাম,...জগন্নাথ দর্শন করে এবং বলাই বাহুল্য পেটপুজো দিয়ে মনে যারপরনাই আনন্দ নিয়ে ফিরেছি।
এখানে মাছের পদগুলি অতি উৎকৃষ্ট এবং মৎস্যরসিকরা এখানে এলে অভিভূত হবেন। আজ টেবিলে বসে তলব করলাম পার্শে এবং বোয়াল মাছ,... আড়ে দীঘে বেশ বড় পার্শে মাছ এবং মানানসই আকারের বোয়াল মাছ পাতে পড়ল। মুখে দিয়েই বোঝা গেলো অত্যন্ত সুস্বাদু এবং ফ্রেশ মাছ। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন যেতেই পারে যে আধিকারিকরা গুণমান নিয়ে আপোষ করেন না।


এছাড়াও নিয়েছিলাম এদের একটি বিশেষ পদ যার নাম দেওয়া হয়েছে "রুই মাছের কবিরাজী ঝোল"। সাধারনতঃ মাছের কবিরাজী শুনলেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তেলে ভাজা ঝুরি ঝুরি ডিমের খোলসে একটি সুপুষ্ট মাছের টুকরো যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিত্র কাফে, দিলখুশা, বসন্ত কেবিন বা আপনজনের মতো বাঘা বাঘা নাম। এই বস্তুটি কিন্তু তার ধার কাছ দিয়েও হাঁটে না। এটি হলো ফুলকপি, আলু, কাঁচকলা এবং পেঁপে দিয়ে বানানো রুই মাছের পাতলা ঝোল। গুরুপাক খেয়ে খেয়ে আপনার পেটের অবস্থা যদি পটলডাঙ্গার প্যালারামের মতো হয় তাহলে আপনার জন্য এই পদটি আদর্শ। পটল দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোলের তুলনায় এর গুন কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। নামের উৎস কি তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে, আমি জিগ্যেস করার সুযোগও পাইনি, কিন্তু আমার নিজের ধারণা, আগেকার দিনে অম্লশুলের রুগীদের জন্য বোধহয় কবিরাজরা এই রকম ঝোল খাবার নিদান দিতেন। তার থেকেই বোধহয় এই নামটা দেওয়া।

পাঁঠার মাংসটা আমার খুব একটা সুবিধার লাগলো না। ঝোলটার স্বাদ ভালো হলেও মাংসের টুকরো গুলো সুসিদ্ধ ছিল না ফলে খেতে যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছিল। জগার ঠেকে মাছেরই জয়জয়াকার, মাংশাসীরা অতটা খুশী হতে পারবেন না।

আর একটা ছোটো দুঃখ থেকে গিয়েছিল,....তা হলো মেনুতে চাটনী এবং পাঁপরের কোনো স্থান নেই।

খাবারের দাম অত্যন্ত পকেট সহায়ক, অল্প পয়সাতে পেটচুক্তি খাওয়া। নিরামিষ থালি পাওয়া যায় তিরিশ টাকাতে,.... মেনু বোর্ডে পরিস্কার লেখা আছে জগন্নাথ ভোজনালয় তিরিশ টাকার নিচে আপনাকে খাওয়াতে অপারগ। সুতরাং ঢুকতে হলে আপনাকে নুন্যতম তিরিশ টাকা পকেটে রাখতেই হবে।

ওই এলাকাতে দুপুরবেলাতে গেলে ছোট করে একবার ঢু মারতেই পারেন। তবে এই অধমের একটা ছোট্ট উপদেশ হলো যেতে হলে একটু আগে আগে পৌছনই ভালো, তা ধরুন বেলা একটার মধ্যে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। নইলে ভিড় বাড়ে। ওই যে একটা শ্যামা সঙ্গীত আছে না.

"আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি,
আমি অনাহুত একজন অনেক দোষে দোষী।"

দেরী করলে আপনার অবস্থা ওই রকম হওয়া বিচিত্র নয়..

অতএব পা চালিয়ে,.......

ঠিকানাঃ
১০৫/৮, সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী রোড
কোলকাতা – ৭০০ ০১৪
টাইমস অফ ইন্ডিয়া অফিসের ঠিক পাশে।